Cute Orange Flying Butterfly 2017-08-20 ~ ‎অচিনপুরের আইয়ুব‬
আস-সালামু আলাইকুম। আমি আইয়ুব আনসারি। আমার লেখাগুলো পড়তে প্রত্যহ ব্লগটি ভিজিট করুন

রবিবার, ২০ আগস্ট, ২০১৭

চট্টগ্রাম ভ্রমণ



২০৪১ সাল।
সকলপ্রকার কর্ম ছেড়ে একেবারে বেকার জীবনযাপন করছি। অন্যের অধীনস্থ কাজ করার স্পৃহা একদম নেই।
ক্যামেরা টা নিয়ে এদিক ওদিক ঘুরেফিরে বাংলার রূপ যৌবন দেখে বেড়ালাম কিছুদিন। এরপর ভাবলাম কিছু একটা করা দরকার।
কলেজ জীবনে একবার সাংবাদিকতার উপর প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম। ভাবলাম সাংবাদিকটাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করি। এতে আমার
একইসাথে মনের শখ আর জীবিকা দুটোই ঠিকঠাক চলবে।
একপর্যায়ে নিজ উদ্দোগে অনলাইন নিউজ পোর্টাল খুললাম। নিয়োগ দিলাম আমার কিছু বেকার বন্ধুদেরকে। ওদের তেমন একটা
মাইনে দিই না।
নাহ! এতেও চলছে না। মন বসছে না কিছুতেই। যারা টিভি চ্যানেল পরিচালনা করে তাদের দিকে তাকালে আমার বর্তমান কাজগুলোকে
কাজই মনে হয় না।
আর দৈনিক পত্রিকার সাংবাদিকদের দিকে তাকালেই তো হিংসে হয়।
তবুও শখ হিসেবে চালিয়ে যাচ্ছি রিপোর্ট সংগ্রহের কাজ। এমন সময় দেশের পূর্বাঞ্চল প্লাবিত হলো।
চট্টগ্রামের উপকূলীয় অঞ্চলের অবস্থা বেহাল। এরই মাঝে কয়েকটা গ্রামের অবস্থা এক্কেবারে শংকাজনক।
কোনদিন চট্টগ্রাম যাওয়া হয়নি। বাবার মুখে শুনেছিলাম চট্টগ্রামের রূপের বর্ণনা। যেখানে উত্তরবঙ্গের মানুষেরা সামান্য মাটির ঢিঁবি দেখলেই
তার সাথে আত্মিয়তা শুরু করে সেখানে আকাশছোঁয়া পাহাড়ের কথা শুনলেই কেমন যেন ভাললাগা কাজ করে।
ছুটলাম ওদিকে...
গাড়িতে গেলাম কিছুদূর। তারপর দেখি রাস্তাঘাট অচল।
আমি একটা নৌকায় উঠলাম। নৌকার মাঝি ঝিম মেরে বৈঠা ধরে বসে আছে। হয়তো দু-একজন যাত্রীর জন্যই অপেক্ষা করছেন ।
আরও দুজন মানুষ উঠলো। নৌকা ছাড়ছে না! আমার ভালই উপলব্ধী হচ্ছে। কি প্রশস্ত নদী!
কি মনোরম চতুর্দিক। তারমাঝে আবার ঝিরিঝিরি হাওয়া। আনমনে প্রকৃতির সাথে কথা বলছিলাম।
আচমকা ভটভট শব্দ কানে আসলো। অনেকটা ভয় পেয়ে এদিকওদিক তাকালাম। নৌকায় অনেক যাত্রী উঠেছে।
নৌকা চলছে...
নৌকার নাম সাম্পান আর নদীর নাম কর্ণফুলী।
কর্ণ মানে যদি কান হয় তবে কর্ণফুলী মানে তো কানের ফুল হবার কথা। কোন কালে গাঁয়ের বধুর কানের ফুল এই নদীর জলে হারাবার ফলে
নদীর নাম কর্ণফুলী হয়েছে কি-না আমার জানা নেই।
মাঝি পাশের লোকদের সাথে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলছে অনর্গল; আমি তার সিঁকিও বুঝছিনা।
কানাকানিতে বুঝতে পারছি আমাকে নিয়ে কথা হচ্ছে। চট্টগ্রামের মানুষ নিজেদের আঞ্চলিকতা নিয়ে খুব গর্ব করে। তাচ্ছিল্যের স্বরে আমাদের মতো
বহিরাগত মানুষদের বলে বহিঙ্গা। আর নিজেদের বলে চুইঙ্গা।
এখানেও আমাকে বহিঙ্গা বলছে ফিসফিস করে। ভাবলাম, হয়তো এই "ইঙ্গা" থেকেই রোহিঙ্গা নামের উৎপত্তি। অদ্যকার লোকেরা সম্প্রদায়ের
নামের সাথে "ইঙ্গা" কেন লাগায় তা আল্লাহ মালুম!
তখন ছিলো সন্ধ্যাবেলা। লোকজনের গোলমাল শুনে অনেকটা শঙ্কাও হচ্ছিলো। হটাৎ মনে পড়লো মহাকবি আলাওলের কথা। ইতিহাস থেকে আমরা জানি এই এলাকাতে
জলদস্যু আছে। তবে আজ তো সেই যুগ আর নেই। তবুও ভয় হচ্ছিলো। আমার বুকে একটা ব্যাজ বাঁধা ছিলো, সেখানে আমার পরিচয় লিপিবদ্ধ ছিলো।
কানাকানিতে কেউ কেউ আমাকে পুলিশ বলে সম্বোধন করছে। মনোবল ফিরলো একটু করে। চোখ লেগে আসছিলো, এমন সময় দেখা মিললো চাঁদ মামার।
চাঁদের আলোকচ্ছটা কিছুটা নদীর জলে পড়েছে। হালকা আভায় সেটাকে একটা মুক্তো মনে হচ্ছে, সে কি লোভনীয়।
মনের অজান্তেই চাঁদকে ছোঁয়ার জন্য পানিতে নামতে গেছিলাম। এক পা পানিতে পড়ার সাথে সাথেই এক ঝলক পানি লাগলো গায়ে।
পাশের লোকজন বলতে লাগলো , এ-কি করছেন স্যার?
আমি উঠে দাঁড়িয়ে নিজের হুঁশ ফিরালাম। উপস্থিত লোকজনের মন মানষিকতা দেখে বুঝলাম ওরা আমাকে যথেষ্ট সম্মান করছে। মাঝবয়সী একটা ছেলে আমাকে বলছে,
আপনার বুঝি চোখ লেগে আসছে। দাঁড়ান পানি দিচ্ছি।
কথা শুনে মনে হচ্ছিলো ছেলেটা শিক্ষিত বটে। হাতে একটা পানির বোতল দিয়ে বললো , স্যার! এই নিন আপনার পানি।
- এ-কি! দেখছি তো বিশুদ্ধ খাবার পানি।
ঃ- সরকার তো আমাদের দিকে তাকায় না। আমরা যদি সরকারের লোকদের একটু সেবা করতে পারি তবেই শান্তি মিলবে মনে।
( দেখছি ওরা আমাকে সরকারের কথা শোনাচ্ছে। দূর্গতদের মাঝে সরকার প্রচুর ত্রাণ সরবরাহ করেছে। তবে কি ওনাদের মাঝে এখনো পৌঁছায়নি!)
ভাবতে ভাবতে নৌকার একপাশে গিয়ে হাত নদীর জলে ঠেকিয়ে জল উঠিয়ে চোখমুখ ধুয়ে নিলাম।
এবার পানির বোতল খুলে এক গাল পানি নিয়ে বোতল টা ওর হাতে দিলাম।
চতুর্দিক ঘনকালো ছায়ায় ঢেকে গেলো। ঝড় উঠলো মাঝ নদীতে। মনে মনে দোয়া দরূদ পাঠ করতে শুরু করলাম।
এখন আমি কোথায় আছি? কোনদিকে মুখ ফিরিয়ে তাকিয়ে আছি তার কিছুই বুঝছি না।
নাহ! আমি কারো গল্পেও অংশ নিতে পারছিনা। ওনাদের ভাষা আমার বোধগম্য নয়। মনে হচ্ছে আমি কত্তগুলো ভূতের সাথে আছি।
এমন সময় শূকতারা দেখা দিলো। একটু পরেই ভোর আকাশে সূয্যিমামা হাসিমুখে উদিত হয়েছে।
তার হাসির কিছু অংশ পড়েছে কর্ণফুলীর পানিতে।
যেদিকে তাকাই সেদিকেই শুধু জল আর জল। ওরা দূর গগণের সাথে মিলে গেছে।
 কি অপরূপ দৃশ্য! ভাবছি, যদি এভাবেই কর্ণফুলীর বুকে বাঁকি জীবন ভেঁসে বেড়াতে পারতাম।
এমন সময় কে যেন বলে উঠলো , অল্প সময়ের মাঝে নৌকা থামবে। যদিও ওনাদের আঞ্চলিক ভাষায় বলছিল।
টের পেলাম এমন কিছুই বলছিলো ওরা। ঐতো দেখা যাচ্ছে, দূর থেকেই দেখা যাচ্ছে দুর্যোগ কবলিত গ্রামগুলো। দেখতে দেখতে নৌকা ঘাটে ভিড়লো।
হুড়োহুড়ি করে ঘাটে নামছে সবাই। সবার শেষে আমি নামলাম, দেখা হলো কিছু মানুষের সাথে।
জানতে চাচ্ছিলাম তাদের পরিস্থিতি। হায়! আমি মানুষ নাকি এলিয়েন?
আমি দূর কোন দেশে ঢুকে পড়িনি তো! স্বপ্ন দেখছি নাকি বাস্তব!
উফফ! আমার কথা কেউ কেউ বুঝলেও আমি কারো কথাই বুঝছি না। যা হোক, তাদের সাক্ষাৎকার না নিতে পারলেও অন্তত তাদের চলাফেরা দেখে একটা রিপোর্ট তৈরি করতে
পারবো।
ঢাকা থেকে রওণা হয়েছিলাম দুইদিন আগে। গত সন্ধ্যায় নৌকায় উঠার আগে কর্ণফুলীর তাজা ইলিশ দিয়ে দুমুঠো ভাত খেয়ে এসেছিলাম।
কিন্তু, জানতাম না যে আমাকে ইলিশ খাওয়ানো হয়েছে। খাওয়ার পরে জানতে পারলাম আমি ইলিশ খেয়েছি।
একবার বাড়ি থেকে কলেজে যাওয়ার পথে দৌলতদিয়া ঘাটে ইলিশের গন্ধে বমি করেছিলাম। যতই ভাল করে রান্না করুক না কেনো আমি কখনো ইলিশের ঘ্রাণ সহ্য করতে পারিনি।
অনেকেই আমাকে তিরস্কার করে বলতো আমি নাকি বাঙ্গালী না।
ইলিশ খেয়েছি ভাবতেই মাথার মাঝে কেমন জানি করে উঠলো।
উয়াক! উয়াক! বমি করলাম আবারো। অথচ সারারাত কিছুই হয়নি। যেহেতু আমার সাথে কারো কথা হচ্ছেনা এখানকার সেহেতু একা একা ক্যামেরা নিয়ে রিপোর্ট তৈরি করছিলাম।
এমন সময় নৌকার সেই ছেলেটির দেখা মিললো। যদিও আমি ওর দিকে খেয়াল করিনি।
আমাকে স্যার বলে সম্বোধন করলো। আর আমি সুযোগ বুঝে আমার মনের কথাগুলো খুলে বললাম। ও একটু মুচকি হেসে বললো, সমস্যা নেই আমি আপনার ডাবিং মেশিনের কাজ
করে দেবো।
দেখছিলাম ওনাদের দুঃখ কষ্টগুলো। এদিকে প্রতিবেদনগুলো পাচার করছিলাম ইথারনেটে।
এই এলাকায় অন্য কোন প্রতিবেদক আসেনি, তাই আমার ডাক আসলো সমস্ত চ্যানেল থেকে।
ছেলেটা আমাকে নিয়ে সবকিছু ঘুরেঘুরে দেখাচ্ছিলো। একটা সময় আমি ওনাদের আপন হয়ে উঠলাম।
সন্ধ্যা লাগার উপক্রম! ভাবলাম রওণা দেবো ঢাকার পথে।
এমন সময় কয়েকজন প্রবীণ আমাকে ডেকে অভিযোগ জানালো তাদের খাবার সংকট চলছে। আমাকে সরকারী দলের লোক ভেবে বললো ত্রাণের ব্যবস্থা করতে।
আমি উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করে জানলাম ঐ এলাকার জন্য প্রচুর ত্রাণের বাজেট ছিলো। আর তা হস্তান্তরও হয়েছে।
হতচকিয়ে উঠলাম! এত্ত এত্ত বাজেট, এসব গেলো কৈ?
আরো ত্রাণের আবেদন করলাম।
রাত হয়েছে! এলাকার হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষকের বাড়িতে থাকার আমন্ত্রণ জানালো।
পরদিন দুপুর নাগাদ আসলো ত্রাণ সামগ্রী।
এলাকার চেয়ারম্যানের সহায়তায় তা বিলিয়ে দিলাম সবার মাঝে। আমার যাবার বেলা হয়েছে।
হটাৎ শুনছি পানি বেড়েছে নদীতে। নৌকা চলবে না আগামী তিন দিন।
এই জায়গাতে আমার একটুও মন বসছিলো না। বাধ্য হলাম থাকতে। শুনলাম নৌকা চলছে...
আমার বিদায়ের ক্ষণ এসেছে। সবকিছু গুছিয়ে চলেছি ঢাকার পথে। অনেকদিন হলো ঢাকার ব্যস্ত রূপ দেখিনা।
শহরের যান্ত্রিক ব্যস্ততা হাতছানি দিয়ে ডাকছে আমায়।
পথ আগলে বসেছে এলাকার সবাই। আমারো অনেক মায়া জমেছে ওদের উপর।
যেতে ইচ্ছে করছেনা একদম। তবুও পা রাখলাম নৌকার চাটায়। পেছনে ফিরে দেখি সবাই পিছুপিছু এসেছে ঘাটে আমায় বিদায় জানাতে।
নৌকা চলছে, আমি তাকিয়ে আছি ঘাটের দিকে। চলে এসেছি অনেক পথ ছাড়িয়ে, তাকিয়েই আছি ঘাটের দিকে।
আবছা চোখেও দেখছি লোকগুলো আমার পানে তাকিয়ে আছে ।।